৪০০ বছরের প্রাচীন দুর্গা পূজা 400 Years Old Durga Puja In Bengal

 ৪০০ বছরের পুরনো হরিপালের দুর্গা পুজো।

400 years old Durga Puja at Haripal village of Hooghly district in West Bengal.




দুর্গাবাটীর তোরণে লেখা আছে, এই দুর্গাদালান তৈরি হয়েছিল ১৫৪৪ শকাব্দে। অর্থাৎ, ১৬২২ খ্রিষ্টাব্দে। তবে শোনা যায়, দুর্গাদালান তৈরির আগে থেকেই এই পুজোটা হয়ে আসছে।

ধরে নেওয়া হয়, বাংলায় দুর্গাপুজোর প্রবর্তক নদীয়া-রাজ ভবানন্দ মজুমদার। ১৬০৬ সালে প্রথম দুর্গাপুজোর আয়োজন করেছিলেন তিনি। এর বছর চারেক পর, ১৬১০ সালে দুর্গাপুজো শুরু হয়েছিল কলকাতার সাবর্ণ পরিবারে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে হরিপালের ‘সাতবাড়ি রায়’ (Saatbari Ray) পরিবারের পুজোও প্রায় তার সমবয়সী।

 অন্যান্য বনেদি বাড়ির মতোই, হরিপালের রায় বংশের এই দুর্গাপুজোও বেশ বৈচিত্রময়। রীতি-রেওয়াজ থেকে শুরু করে দুর্গাপ্রতিমার গঠন— প্রতিটি ক্ষেত্রেই আর পাঁচটা বাড়ির দুর্গাপুজোর থেকে খানিক আলাদা রায় বাড়ির এই পুজো।

বাড়ির সঙ্গে সরাসরি যোগ রয়েছে মুঘল আমলের। সম্রাট আকবরের থেকেই ‘রায়’ খেতাব পেয়েছিলেন এই বাড়ির আদিপুরুষ তথা মুঘল রাজকর্মচারী শিবদাস দে মজুমদার। হুগলির ছোট্ট গ্রাম হরিপালকে সাজিয়ে তোলার নেপথ্যে ছিলেন তিনিই। গ্রামবাসীদের জন্য জলাশয় খনন থেকে শুরু করে দরিদ্র ব্রাহ্মণদের জমিদান— বলতে গেলে তাঁর হাত ধরেই ধীরে ধীরে জনপদ হয়ে উঠেছিল হরিপাল। পরবর্তীতে তাঁর সাত ছেলে সম্রাট শাহ আলমের কাছ থেকে উপহার পেয়েছিলেন বিস্তীর্ণ নিষ্কর জমি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরবর্তীতে সাত ভাগে ভেঙেছে পরিবার। গ্রামের কুমোর, সূত্রধর, কামার কিংবা মালি— সকলেই সমানভাবে অংশ নেন এই পুজোয়। বংশপরম্পরায় এটাই এ বাড়ির রীতি। কথিত আছে, একসময় বনেদি বাড়ির পুজোতে প্রবেশাধিকার পেতেন না নিম্নবর্গের মানুষরা। সেই ক্ষোভ থেকেই জন্ম নিয়েছিল বারোয়ারি পুজোর। অথচ দেখতে গেলে বনেদি বাড়ির পুজো হয়েও কোথাও যেন বারোয়ারি হয়ে উঠেছে রায় পরিবারের এই পুজো। 

পরিবারের কুলদেবতা রাধাগোবিন্দ। সপ্তদশ শতকে রায় পরিবার নির্মিত একাধিক রাধাগোবিন্দের মন্দিরও রয়েছে হরিপাল জুড়ে। টেরাকোটায় সজ্জিত এইসব মন্দির। অবশ্য সংরক্ষণের অভাবে জীর্ণ অবস্থা তাদের। ক্রমশ ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে টেরাকোটার কাজ। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, রাধাগোবিন্দের উপাসক হলেও, বৈষ্ণবমতে নয় বরং শাক্তমতেই পুজো হয় রায়বাড়িতে। এমনকি ৪০০ বছরের পুরনো এই পুজোর প্রতিমার গঠনও বেশ বিচিত্র। একচালার প্রতিমার ক্ষেত্রে সাধারণত উপরে রাখা হয় লক্ষ্মী ও সরস্বতীকে। তার নিচে থাকেন কার্তিক-গণেশ। তবে রায়বাড়ির প্রতিমা তৈরি হয় ঠিক এর উল্টোভাবে। অর্থাৎ, দেবীর দু’দিকে উপরের অংশে রাখা হয় কার্তিক ও গণেশকে। নজর কাড়ে কলাবউ-এর সংখ্যাও। একটির বদলে এই পুজোয় তিনটি কলাবউ গণেশের। 

সময় দেখেই শুরু হয় সন্ধিপুজো। এই পুজো যখন শুরু হয় তখন আজকের মতো ঘড়ির চল ছিল না। তখন সূর্যঘড়ি অথবা জলঘড়ি দিয়েই পুজোর সময় নির্ধারণ করা হত। সময় বদলালেও, পাল্টায়নি সেই রীতি। চারশো বছর পেরিয়ে আজও বংশ পরম্পরায় জলঘড়ি দেখে পুজোর সময় নির্ধারণ করে চলেছেন রায়বাড়ির কুল-পুরোহিতরা।

অন্যান্য বনেদি বাড়ির মতোই, ছাগবলির প্রচলন রয়েছে রায়বাড়িতে। সঙ্গে বলি দেওয়া হয় লেবু, ছাঁচি কুমড়ো, আখ। আগে মহিষ বলির চল ছিল। বলি দেওয়ার পদ্ধতিও বেশ বিচিত্র। তোপধ্বনি দিয়ে শুরু হয় বলি। একটা সময় কামান বা বন্দুক দাগার চল ছিল রায় পরিবারে। আজ গাছবোমা ফাটিয়েই শুরু হয় বলি। 

বিষয় হল বিসর্জন। মহিলারা নন, বরং পরিবারের পুরুষ সদস্যরাই বরণ করেন দেবীকে। সঙ্গে থাকেন দুই ব্রাহ্মণ। একটা সময় কেবলমাত্র মশালের আলোয় আলোকিত পথে ভাসানে যেতেন দেবী। আজ বৈদ্যুতিক আলোর চল বাড়লেও, মশালের ঐতিহ্যে ছেদ পড়েনি। আজও দুটি মশাল সঙ্গী হয় দেবীর বিসর্জন-যাত্রার। কাঁধে চেপেই গঙ্গাবক্ষের দিকে রওয়ানা দেন দেবী।

Comments